E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২১ মে, ২০২১ / ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

মানুষের হাহাকার শুনেও মানবতার পতন দেখেও নির্লজ্জ অলসভাবে বয়ে চলেছে গঙ্গা

সন্দীপ দে


‘‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের
হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে
ও গঙ্গা তুমি গঙ্গা বইছো কেন?’’...


আজ গঙ্গা বিধৌত ভারতের ভয়ঙ্কর দুর্দশাগ্রস্ত ছবি যেন এই গানটিকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক ‘ডিজিটাল যুগে’ দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে উত্তর প্রদেশ-বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রবাহিত গঙ্গার বুকে প্রতিদিন ভেসে যাচ্ছে অগণিত মানুষের লাশ এবং গঙ্গার তীরে বালুচরে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ লাশ কুকুর-চিল-শকুনের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে - যা আজকের আধুনিক সভ্যতাকেই যেন তীব্র উপহাস করছে!

সত্যিই আমরা ‘আচ্ছে দিন’-এ প্রবেশ করেছি! বহু কোটি টাকার বিজ্ঞাপন-আলোড়িত ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর প্রকৃত চেহারা যেন এখন উদ্ভাসিত হচ্ছে!

ভারতের মতো একটি দারিদ্র্য-পীড়িত দেশে গঙ্গা নিয়ে প্রকৃত কাজের চেয়ে আদিখ্যেতা কম হয়নি। যে দেশে চরম দারিদ্র্যের সাথে নিরক্ষরতা-অশিক্ষা ও খাদ্যাভাব প্রবল, সেখানে সমস্ত ধরণের দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা এবং এর গুরুত্ব যে অবহেলিত হবে তা বলাই বাহুল্য। গত কয়েক দশক ধরে গঙ্গাকে দূষণ মুক্ত করার লক্ষ্যে ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’-এর আওতায় কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ১৯৮৬ সালের ১৪ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এই ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান‘ বা ‘গ্যাপ’-এর সূচনা করেছিলেন। এই প্রকল্পের জন্য দুই পর্যায়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও ‘পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা’ পতিতই থেকে গেছে। এসব করে আখেরে কী লাভ হয়েছে তা আজ কারও অজানা নেই। এমন কোনো বর্জ্য পদার্থ নেই যে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করা হয়না। মানুষের ব্যবহার্য পরিত্যক্ত জিনিস থেকে শুরু করে মানুষ ও পশুর মলমূত্র, মৃত গবাদি পশু, কলকারখানার নিষ্কাশিত যাবতীয় নোংরা পদার্থ - সব কিছুরই নিক্ষেপের স্থান যেন নদীবক্ষ! অথচ ভারতের মতো গরিব দেশের অগণিত মানুষের (৪০ শতাংশের বেশি) জীবন নির্বাহ চলছে এই গঙ্গাকে কেন্দ্র করে। দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে চাষবাস এমনকি সরকারি উদাসীনতায় সবার জন্য পানীয় জলের বন্দোবস্ত না থাকায় অসংখ্য মানুষকে তৃষ্ণা নিবারণের জন্যও নির্ভর করতে হয় এই গঙ্গাজলের উপরেই। আর এই দেশে বিজ্ঞান চেতনার অভাবে অন্ধ কুসংস্কার ও তীব্র ধর্মীয় ভাবালুতা দৃঢ়ভাবে সমাজ মানসে জাঁকিয়ে থাকায় গঙ্গানদী নিয়ে বুজরুকি কারবার, ধর্মীয় উন্মাদনারও অন্ত নেই। আর এই সময়ে ‘গঙ্গা মাইয়া কা পূজন’-এর বাড়বাড়ন্ত তো মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। অথচ আজ এই গঙ্গার বুকেই এখন মানুষের শতশত লাশ ভাসছে! একটা সভ্য দেশে এর চেয়ে লজ্জা আর কলঙ্কের কী হতে পারে?

হয়তো অনেকেরই স্মরণে আছে ২০১৪ সালের মে মাসে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘‘মা গঙ্গার সেবা করাই আমার ভাগ্যের লিখন।’’ এই বছরেই প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার পার্কে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের এক সভায় বলেছিলেন, ‘‘যদি এই নদীকে আমরা পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারি, তাহলে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের বিরাট উপকার হবে। তাই, গঙ্গাকে পরিষ্কার করার কাজটি এক ধরনের অর্থনৈতিক কর্মসূচিও বটে।’’ প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ‘নমামি গঙ্গে’ নামে এক সুসংহত গঙ্গা সংরক্ষণ অভিযান চালু করে। গঙ্গা নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও নদীর পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ পর্যন্ত ২০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ করে। পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি এই প্রকল্পের বরাদ্দ আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়।

এই পরিকল্পনায় প্রাথমিক পদক্ষেপের মধ্যে ছিল নদীর জলে ভেসে থাকা কঠিন বর্জ্য পদার্থ মুক্ত করে জলকে পরিষ্কার করা, দূষণ নিয়ন্ত্রণে গ্রামীণ স্তরে পরিচ্ছন্নতার কর্মসূচি গ্রহণ, গ্রামাঞ্চলে নর্দমা বাহিত হয়ে কঠিন ও তরল বর্জ্য নদীতে পড়ে যাতে দূষণ না ঘটায় সেদিকে নজরদারি করা। এছাড়া শৌচাগার নির্মাণ, নদী তীরের শ্মশানগুলির আধুনিকীকরণ এবং পুনর্গঠন করে আধপোড়া অথবা আংশিকভাবে পোড়ানো মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেওয়ার প্রথা বন্ধ করা। এসবের পাশাপাশি নদীর ঘাটগুলি মেরামত ও আধুনিকভাবে নির্মাণের মাধ্যমে মানুষ ও নদীর মধ্যে ব্যবহারিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো। এছাড়া শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দূষণ সংক্রান্ত আইন-কানুনগুলি আরও ভালোভাবে প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে গঙ্গা তীর বরাবর যে সমস্ত শিল্প সংস্থা মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছড়ায়, সেগুলির বর্জ্যের পরিমাণ ও দূষণের তীব্রতা কমাতে এবং তরল বর্জ্য নিষ্কাশন সম্পূর্ণ বন্ধ করার নির্দেশ জারি হয়। এইসব নির্দেশাবলি যাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদগুলি রূপায়ণ করতে পারে তার জন্য পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। কানপুর, এলাহাবাদ (অধুনা প্রয়াগরাজ), বারাণসী, পাটনা, সাহেবগঞ্জ, হরিদ্বার, বৃন্দাবন, মথুরা ও নবদ্বীপ প্রভৃতি শহরে এই প্রকল্প রূপায়ণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ক্যাবিনেট সচিবের পৌরহিত্যে একটি উচ্চস্তরীয় টাস্কফোর্স এই প্রকল্পের ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার কাজকর্ম দেখভাল করবে বলে স্থির হয়। এই কাজে আগেকার বরাদ্দ ২,৩০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ ছাড়াও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা আরও ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে। গত তিন দশক ধরে গঙ্গা দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়েছে এই অর্থ তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অভিমত। এই ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পে আটটি রাজ্যের গঙ্গা ও তার উপনদী মিলিয়ে ১২টি নদনদী ও ৪৭টি শহর প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের সার্বিক রূপায়ণে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে অনুমান করা হয়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কেন্দ্রের সরকার জানায়, ৬ বছরের মধ্যে ১ হাজার ৬২০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথে এই কাজ করা হবে।

নিঃসন্দেহে এটি একটি মহতী প্রকল্প। কিন্তু ভারতের মতো একটি দারিদ্র্যপীড়িত, রোগ ও অপুষ্টি জর্জর, নিরক্ষরতা ও অশিক্ষার অন্ধকার লাঞ্ছিত দেশে এই সমস্ত মৌলিক সমস্যা সমাধানের কোনো ভাবনা,বাস্তবোচিত পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিয়ে, সরকারের কাজের কোনো অগ্রাধিকার স্থির না করে ‘নমামি গঙ্গে’-এর মতো প্রকল্প নিয়ে মাতামাতি কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে। শুধু তাই নয়, এই প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শ্মশ্রুমণ্ডিত ছবি সহকারে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপনী বাগাড়ম্বর দেশবাসীর কোন্ কল্যাণে লেগেছে তা দেশের আজকের অবস্থা সম্যকভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে!

কেন্দ্রের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারের সীমাহীন অজ্ঞতা, অপরিণামদর্শিতা ও ব্যর্থতার সঙ্গে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অবিমৃশ্যকারিতায় কোভিড সংক্রমণের করাল থাবায় আজ বিপর্যস্ত গোটা দেশ। হাসপাতালের বেড থেকে শুরু করে অক্সিজেনের তীব্র সঙ্কট, ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে দেশের তাবড় বড়ো শহর সহ মফস্‌সল-গ্রাম সর্বত্র মৃত্যুর বিভীষিকা মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, দেশজুড়ে যেন মৃত্যু মিছিল চলছে। আরও মারাত্মক ঘটনা হলো কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিদের সৎকার করা হচ্ছে না। মৃত্যুর সংখ্যা এতই বিপুল যে শ্মশানে, কবরস্থানেও জায়গা সঙ্কুলান করা যাচ্ছে না। মৃতের সংখ্যা আড়াল করে সরকার নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে তৎপর। তাই কোভিড সংক্রমণে মৃতদের দেহগুলিকে বেওয়ারিশ হিসেবে যথেচ্ছভাবে নিক্ষেপ করা হচ্ছে গঙ্গায়, অথবা নদীর বালুকাবেলায় পুঁতে দিয়ে দায় সারছে। তাই উত্তরপ্রদেশ, বিহারে গঙ্গা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে রাশি রাশি শবদেহ। নগ্ন-অর্ধনগ্ন, পচাগলা দেহগুলি স্রোতে ভেসে এসে পাড়ে গিয়ে ঠেকছে। বিজনোর, মীরাট, মুজফ্‌ফরনগর, বুলন্দশহর, হাপুর, আলিগড়, কাসগঞ্জ, সম্ভল, আমরোহা, বাদাউন, শাহজাহানপুর, হরদোই, ফারুক্কাবাদ, কনৌজ, কানপুর, উন্নাও, রায়বেরিলি, ফতেপুর, এলাহাবাদ, প্রতাপগড় প্রভৃতি প্রসিদ্ধ জেলাগুলির বিভিন্ন ঘাটে দেহগুলি ভেসে উঠছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ক্ষেত্র বারাণসী সহ চন্দৌলি, গাজিপুর, বালিয়ার একাধিক গ্রামেও এই ভয়াবহ দৃশ্য চোখে পড়ছে। স্বজন হারানো যন্ত্রণাক্লিষ্ট অসহায় মানুষেরা জানতেও পারছেন না যে, নদীতে ভেসে আসা বা অন্ত্যেষ্টির সুযোগ থেকে বঞ্চিত তাদের প্রিয়জনের দেহকে খুবলে খাচ্ছে কুকুর-চিল-শকুনেরা! এমনই মৃত্যু উপত্যকার ভয়াল দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠছে মানুষের বিবেক! সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে - উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে গঙ্গা তীর কার্যত ‘মহাশ্মশানে’ পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রতি এখানকার শুক্লাগঞ্জ ও বক্সারঘাটে ন’শোরও বেশি মৃতদেহের শেষকৃত্য করা হয়েছে। অবস্থা এমনই যে, এখানে গঙ্গা পাড়ে পা ফেললেই মানব দেহের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পায়ে ঠেকেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা সেইসব দেহাংশ খুঁটে খুঁটে খেয়েছে কুকুর-চিল-শকুনের দল!

একইভাবে কনৌজে মহাদেবী গঙ্গা ঘাটের কাছে সৎকার হয়েছে ৩৫০-এরও বেশি মৃতদেহ। এখানে মাটি চাপা দিয়ে পরিস্থিতিকে ঢেকে রাখতে চেয়েছে প্রশাসন। তারপর যখন গঙ্গার জল বেড়েছে তখন ভেসে উঠেছে দেহগুলি। তারপর ভেসে গেছে এক জেলা থেকে অন্য জেলায়।

উত্তরপ্রদেশের অন্যতম শহর কানপুরের শেরেশ্বর ঘাট থেকে আধ ঘণ্টার দূরত্বের মধ্যে অসংখ্য দেহের সৎকার হয়েছে। যতদূর দৃষ্টি যাবে শুধু মৃতদেহ নজরে আসবে। এই সংখ্যা অন্তত চারশো। এখানেও দেখা গেছে কুকুর সহ পশু-পাখি মৃতদেহে কামড় বসাচ্ছে।

একইভাবে গাজিপুর, বালিয়া, ভাদোহি, চান্দৌলি, মির্জাপুর, ফতেপুর সহ অন্যতম ধর্মস্থান এলাহাবাদ ও বারাণসীর গঙ্গাতেও অসংখ্য লাশ ভাসতে দেখা গেছে। বালিয়ায় নদীতীরে পুলিশকে শবদেহে পেট্রোল ঢেলে টায়ারে আগুন দিয়ে জ্বালানোর ভয়ঙ্কর দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসায় নিজেদের মুখ বাঁচাতে তড়িঘড়ি কয়েকজন পুলিশ আধিকারিকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এলাহাবাদের সঙ্গমনগর ছাড়াও বারাণসীর গঙ্গায় লাশ ভেসে ওঠা বিজেপি শাসনের কদর্য রূপকেই যেন প্রকট করছে। প্রধানমন্ত্রীর নাকি দত্তক নেওয়া শহর এই বারাণসী, যা আবার তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রও বটে! এখানেই গঙ্গাতীরে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ হাতে তাঁর নিমীলিত চোখে ধ্যানমগ্ন ছবি স্তাবক মিডিয়ার সৌজন্যে ও সরকারি প্রচারে জনসমক্ষে এসেছে। কিন্তু কী পরিহাস! প্রধানমন্ত্রীর আরাধ্যা গঙ্গাতেই আজ বেওয়ারিশ লাশ ভাসছে!

উত্তরপ্রদেশের গঙ্গায় ভেসে থাকা লাশগুলিই স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে চলে আসছে বিহারের বক্সার সহ অন্যান্য জায়গায়। শুধুমাত্র বক্সারের গঙ্গাঘাটেই বিগত কয়েক দিনে শতাধিক লাশ উত্তরপ্রদেশ থেকে ভেসে এসেছে বলে প্রশাসন কবুল করেছে।

মানবতার এই চরম অবমাননা সত্ত্বেও কোনো সংবিৎ নেই কেন্দ্রের সরকারের। কোভিড সংক্রমণের মোকাবিলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ, বিশেষ করে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মরণ কামড় থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, এমনকি ‘হু’-র সতর্কতা সত্ত্বেও কোনোরকম আগাম প্রস্তুতিই নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রের সরকার তথা মহাশক্তিধর প্রধানমন্ত্রীর ধারণা হয়েছিল দেশ থেকে করোনা বিদায় নিয়েছে। এমনই এক ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী কয়েক মাস আগে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে সদম্ভে ঘোষণা করেন, করোনার বিরুদ্ধে ভারতের জয় সূচিত হয়েছে। তাই এবার ভারত করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে সাহায্য করবে। এমনকি বিজেপি’র জাতীয় কর্মকর্তাদের সভায় মোদীর নেতৃত্বে এই ‘সাফল্যে’র জন্য প্রস্তাবও পাশ হয়ে যায়। এই মারাত্মক ভ্রান্তির বশবর্তী হয়েই সরকার সমস্ত ধরণের বিধিনিষেধ তুলে দেয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কোভিড বিধিকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে মগ্ন থেকেছেন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের নেশায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অন্যতম দোসর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে প্রায় যেন ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন, বড়ো বড়ো সভা-মিছিলে অংশ নিয়েছেন। দেশের সরকারের অন্যতম দুই কাণ্ডারি যখন এই চূড়ান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করেছেন, তখন সরকারের অবস্থা সহজেই অনুমেয়! শুধু তাই নয়, কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই বিজেপি সরকার প্রকট হিন্দুত্ববাদী আবেগের বশবর্তী হয়ে একমাসব্যাপী কুম্ভমেলা বন্ধ করার পরিবর্তে মেলার অনুমতি দিয়েছে এবং সেখানে হাজার হাজার পুণ্যার্থীর আগমন ঘটেছে। মেলাশেষে কুম্ভে আসা অসংখ্য মানুষের সংক্রমিত হবার খবর মিলেছে। করোনাকে ‘পরাজিত’ করার আনন্দে মশগুল হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার দেশে টিকাকরণের কাজে চরম অবহেলা করেছে, এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি গড়া ও নেতা হবার বাসনায় এই সময়ে বিদেশে টিকা রপ্তানি করার মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রের সরকারের এই সীমাহীন অপদার্থতায় আজ দেশের বুকে মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার মারণঘাতী সংক্রমণে কেবল মৃত্যুর সংখ্যা সীমা ছাড়ায়নি, ব্যাপক মৃত্যুর কারণে শ্মশান ঘাটে, কবরস্থানেও মৃতদের জায়গা মিলছে না! নদীতটে বা খোলা জায়গায় প্রকাশ্যে গণচিতার আয়োজন হয়েছে। এর পাশাপাশি গঙ্গার বুকে অগুণতি লাশ ভাসছে, নদীতীরে বালি দিয়ে ঢেকে রাখা লাশগুলি পশুপাখির খাদ্যে পরিণত হচ্ছে! সাত বছরের মোদী শাসন আজ দেশের সামনে এই ‘কীর্তি’ই তুলে ধরছে!

কেন্দ্রের সরকার যদি ন্যূনতম বিবেচনাবোধ ও দায়িত্ব সচেতনতায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে দেশে উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলত, কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করত, তবে আজ দেশের নানা প্রান্তে হাসপাতালে বেডের অপ্রতুলতা, অক্সিজেনের আকাল, আইসিইউ এবং ভেন্টিলেশন সর্বোপরি দেশময় টিকার প্রবল অভাব দেখা দিত না; দেশটাও এভাবে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হতো না! সরকারের এই মাত্রাছাড়া উদাসীনতা ও অপদার্থতায় যখন দেশজুড়ে রোগাক্রান্ত বিপন্ন মানুষ ও তাদের প্রিয়জনেরা সামান্য একটু চিকিৎসা পাবার আশায় হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরছেন, মুমূর্ষু রোগীরা যখন চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, দেশজুড়ে যখন হাহাকার-আর্তনাদ পরিস্থিতিকে ক্রমশ বিষাদময় করে তুলছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকার ‘মান্যবর প্রধানমন্ত্রীজি’র আকাঙ্ক্ষা (নাকি খেয়ালিপনা)-কে মান্যতা দিতে তাঁরই সাধের ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ নামের ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নির্মাণে বাড়তি তৎপরতা দেখাচ্ছে। কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলায় যখন জরুরি কিছু পরিষেবা ছাড়া সমস্ত কিছুই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে এই প্রকল্পকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে ‘জরুরি পরিষেবা’র আওতায় নিয়ে এসেছে কেন্দ্রের সরকার। এছাড়া কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর বিলাসিতার জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করে রাজকীয় হাওয়াই জাহাজ কেনা হয়েছে। অথচ এই বিপুল অর্থ প্রধানমন্ত্রী মোদীর খামখেয়ালিপনায় বিলাসিতার জন্য খরচ না করে দেশময় অক্সিজেনের অভাব অনেকটাই মেটানো যেত।

হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত বেড, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর সহ চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করা যেত। দেশে এভাবে ভয়াবহ মৃত্যু মিছিল প্রত্যক্ষ করতে হতো না, নদীতে লাশ ভেসে যাবার মতো মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা যেত না, শ্মশানে শত শত মৃতদেহের লাইন পড়তো না এবং বেওয়ারিশ মৃতদেহগুলি সৎকারের অভাবে পশু পাখিদের খাদ্যে পরিণত হতো না! এর আগে দেশবাসীর অভিজ্ঞতায় আছে, নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ আগ্রহেই গুজরাটের নর্মদা জেলার ছোট্ট একটি দ্বীপে স্রেফ হিন্দুত্বের ধ্বজা ওড়াতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বল্লভভাই প্যাটেলের বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হয়। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির অনুকরণে-এর নাম দেওয়া হয় ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’। মোদী জমানায় দেশে কেমন ‘ইউনিটি’ রক্ষিত হচ্ছে তা আর কারও অজানা নেই। এই মূর্তি তৈরির সময় চাষের জল ও ফসলের দাম না পাওয়া সংলগ্ন অঞ্চলের কৃষকেরা সঙ্গত কারণেই বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। দেশের মানুষ এদের এমন উদ্ভট কার্যকলাপের আরও একটি নজির প্রত্যক্ষ করেছেন গত বছর লকডাউনের সময়ে। দেশে তখন করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতায় বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ, হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক রুজিরোজগার খুইয়ে আপন বাসস্থানে ফেরার আশায় খিদেয়-তৃষ্ণায় মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছেন, সেই সময় উগ্র হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী প্রধানমন্ত্রী মানবিকতার চরম দুর্দিনে সাড়ম্বরে শিলান্যাস করেছেন ১,১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মান রামমন্দিরের। মানুষের বিপন্নতা, হাহাকার কিন্তু তখন তাঁর চোখে পড়েনি!

আর আজ উত্তরপ্রদেশ জুড়ে যেভাবে সীমাহীন মৃত্যুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ছে এবং গঙ্গার বুকে ভেসে যাওয়া রাশি রাশি শবদেহের ছবি গাটা দেশের গায়ে কলঙ্ক লেপন করেছে, তাতে সেখানকার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সহ সার্বিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্য অবস্থাই বেআব্রু হয়ে পড়েছে। মোদী শিষ্য যোগী আদিত্যনাথ নেতৃত্বাধীন সরকার শুধু স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন, সাধারণ মানুষের কোনো মৌলিক সমস্যা ও চাহিদার দিকে না তাকিয়ে মত্ত থেকেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি রূপায়ণে। অন্যদিকে এই সরকারের জনস্বার্থবিরোধী নীতি ও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপের নিন্দায় যারাই মুখর হয়েছেন, তাদেরকে বিনাবিচারে কঠোর ধারায় আটক করা হয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে ‘লাভ জিহাদ’-এর নামে, ‘অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড’ ও 'গো-রক্ষা বাহিনী' গঠন করে গৈরিক বাহিনীর হিংস্র দমন পীড়নে মদত দিয়েছে। এদিকে সরকারের এই অপদার্থতায় ‘রাম রাজ্যে’ আইন শৃঙ্খলা একেবারে রসাতলে গেছে। রাজ্যে একের পর এক নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। উন্নাও, বিজনৌর, হাথরস সহ অতি সম্প্রতি সোনভদ্র জেলার বীজপুরে নারী নির্যাতনের ঘটনা এই ‘রাম রাজ্যে’র প্রকৃত চেহারাকেই যেন তুলে ধরছে! কাজেই এমন একটি রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার ন্যূনতম সুযোগ না পেয়ে করোনার মতো ভয়ঙ্কর মারণ সংক্রমণে অগণিত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, প্রশাসনিক ব্যর্থতায় তাদের লাশ ভেসে যাবে গঙ্গার স্রোতে এবং সেই সমস্ত লাশ খুবলে খাবে পশুপাখিতে, এ যেন অনিবার্য পরিণতি! মানবতার এমন নিষ্ঠুর পরিণতিই আজ সহ্য করতে হচ্ছে দেশবাসীকে!

অনেকেরই স্মরণে আছে, ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প প্রণয়নের ৪ বছর পর স্পিডবোটে চড়ে সাধের এই প্রকল্পের হাল-হকিকত সরেজমিনে দেখতে কানপুরে এসে অটল ঘাটে হুমড়ি খেয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেদিন নমো’র এই পতন নেহাতই কাকতালীয় নাকি এক অশুভ সমাপতন - এ নিয়ে যে চর্চাই হোক না কেন বর্তমান অবস্থা কিন্তু প্রকট করছে প্রধানমন্ত্রীর সাধের প্রকল্পের বর্তমান দশা কী!

তাই আজ স্বপ্নবিলাসী মোদীর বহু বিজ্ঞাপিত ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প যেন তীর্যক ভঙ্গিতে তাঁর দিকেই তীব্র পরিহাস ছুঁড়ে দিচ্ছে!

এই দুর্ভর যন্ত্রণাদগ্ধ সময়ে গঙ্গার এই চরম দুর্দশাগ্রস্ত হতশ্রী রূপ প্রত্যক্ষ করে নিবন্ধের সূচনায় উল্লেখিত সেই গানেরই আরও কয়েকটি কলি যেন চরম বাস্তবতায় সবার হৃদয়েই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে -
‘‘নৈতিকতার স্খলন দেখেও
মানবতার পতন দেখেও
নির্লজ্জ অলসভাবে বইছো কেন!’’...