E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২১ মে, ২০২১ / ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

ভারতবাসীর মস্তিষ্কে মিথ্যা রোপণঃ প্রসঙ্গ টিকা


অসত্য ভাষণে পারদর্শী আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী এবং তাঁর পারিষদরা তথাকথিত ভারতীয় ভ্যাকসিন সম্পর্কে যে মূল্যবান কথা বলছেন এবং আমরা গোগ্রাসে গিলতে বাধ্য হচ্ছি সেগুলির কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো। পাঠকদের অনুরোধ তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন।

অসত্য - ১: ২৮ জানুয়ারি নরেন্দ্র মোদী ওয়াল্ড ইকনমিক ফোরামে তাঁর ভাষণে ভারতে তৈরি কোভিড টিকা সম্পর্কে বললেন যে, আমরা টিকা তৈরির পরিকাঠামো প্রস্তুত করে ফেলেছি। ভারতে তৈরি দুটি টিকা আমাদের চাহিদা পুরণ করে অন্য দেশকে সাহায্য করতে সক্ষম হবে। শুধু এই দুটি নয় আরও কিছু টিকা তৈরির সংস্থা ভারতে টিকা তৈরি করবে। প্রধানমন্ত্রীর এই বদান্যতা আসলে কী?

যখন দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হলো যে, আমাদের দেশের টিকার চাহিদা না মিটিয়ে প্রায় ৭ কোটি ডোজের বেশি টিকা ভারতের বাইরে পাঠান হলো কেন? যখন এদেশের মানুষ চিকিৎসা ও টিকার অভাবে মারা যাচ্ছে তখন সরকারের এ বদান্যতা কেন? বিব্রত বিজেপি তাদের মুখপত্র সম্বিত পাত্রকে দিয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে আসল সত্য প্রকাশ করল। তিনি বললেন, আসলে ৬ কোটি টিকা ব্যবসায়িক চুক্তির কারণে বিদেশে পাঠাতে বাধ্য হয়েছি। টিকার প্রযুক্তি আমাদের নয়। তাই যারা প্রযুক্তি দিয়েছে এবং তৈরির উপকরণ ও কাঁচামাল দিয়েছে তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এই টিকা আমরা দিতে বাধ্য। অবশ্য বাকি ১ কোটি টিকা কিছু দেশে রপ্তানি করেছে ভারত সরকার।

২৬  মার্চ জাতিসঙ্ঘের (United Nations) সাধারণ সভায় ভারতের প্রতিনিধি নাগরাজ নাইডু বলেন যে, আমরা দেশের বাইরে বিশ্বের প্রতি এতোটাই দায়বদ্ধ যে দেশে যত টিকা আমরা দিয়েছি তার চেয়ে বেশি টিকা বিদেশে পাঠিয়েছি।

অসত্য - ২: ২১ ফেব্রুয়ারি বিজেপি’র জাতীয় পদাধিকারীদের বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবে টিকা তৈরি ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয় যে মোদীর দক্ষ, দায়বদ্ধ, সংবেদনশীল এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব কোভিডকে পরাজিত করেছে।

অসত্য - ৩: ১১ মার্চ নরেন্দ্র মোদী ভারতে টিকা দেওয়ার উদ্বোধন  (vaccine launch) করতে গিয়ে বলেন “Our scientists in a quick time came out with vaccines.” - আমাদের বিজ্ঞানীরা খুব কম সময়ে টিকা তৈরি করেছেন। তাঁর বক্ত্যব্যে আরও উঠে আসে যে, এই টিকা অন্য দেশকে দিয়ে আমরা মানবতার প্রতি এক মহান দায়িত্ব পালন করব।

কোভিশিল্ড তৈরির ক্ষেত্রে ‘আমাদের বিজ্ঞানী’ কথাটি পুরোপুরি অসত্য। এই টিকার পেটেন্ট অ্যাস্ট্রাজেনিকা নামে এক ব্রিটিশ কোম্পানির। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধ্যাপিকা সারা গিলবার্টের নেতৃত্বে তৈরি এই টিকা গবেষণার খরচের ৯৭ শতাংশ  ব্রিটিশ নাগরিকদের দেওয়া ট্যাক্স থেকে এসেছে। ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট এই টিকার প্রস্তুতকর্তা মাত্র। কোভাকসিনের সঙ্গে আইসিএমআর এবং ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি কতটা এবং কিভাবে যুক্ত আছে তা সরকার পরিষ্কার করে বলছেনা। বিদেশি গবেষণা সংস্থা যুক্ত থাকার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায়না। তাতে কোনো অপরাধ দেখিনা। জ্ঞানের আদান প্রদানই তো এই মুহুর্তে জরুরি। যদি আইসিএমআর’র মতো সরকারি সংস্থার কাছে এই টিকার পেটেন্ট থাকে তবে ভারত বায়োটেকের মতো একটি পুরোপুরি বেসরকারি সংস্থাকে এই টিকা তৈরির সমস্ত দায়িত্ব দেওয়া হলো কেন? দেশের মানুষের করের টাকায় পরিচালিত আইসিএমআর’র পেটেন্টে বাণিজ্য করছে ভারত বায়োটেক?

অসত্য - ৪: ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেন যে, টিকার জন্য বাজেট বরাদ্দ হলো ৩৫,০০০ কোটি টাকা। সরকার টিকা গবেষণের জন্য ১ পয়সাও খরচ করেনি। এমনকি দেশে করোনা ভাইরাসের যে পরিবর্তিত রূপ দেখা যাচ্ছে তাকে ভাল করে বুঝতে দেশের ১০টি  ভাইরাস গবেষণাগারের একটি যৌথ জিনোমিক কনসোর্টিয়াম  (INSACOG) তৈরি করা হয়। এই উদ্যোগের জন্য আর্থিক বরাদ্দ ছাঁটাই করে গবেষণার কাজ ব্যাহত করা হয়েছিল। সারাদেশের ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কেরল বাদ দিলে অন্য কোনো রাজ্য সহায়তা করেনি (India Today, Tragedy of Errors, ১৭ই মে ২০২১)। তাহলে সব টাকাই টিকা কিনতে ব্যবহার করা উচিত। এই টাকায় দেশের ১০০ কোটি মানুষের টিকাকরণ হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক টালবাহানার পর ১৩মে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক বলে যে, এ পর্যন্ত  সর্বমোট ৫৭ কোটি টিকার অর্ডার দেওয়া হয়েছে যা দিয়ে মাত্র ২৮.৫ কোটি মানুষের টিকাকরণ হবে।

এগুলি কয়েকটা নমুনা মাত্র। নিজেদের অপারগতা, পরিকল্পনাহীনতা এবং কর্পোরেট নির্ভরতাকে ঢাকতে এই মিথ্যা ভাষণ আমাদের সইয়ে নেওয়ার জন্য বলা হয়। তত্ত্বটা এমন যে, মিথ্যায় সম্পৃক্ত মানুষ সত্যের অনুসন্ধানে আগ্রহী হবেনা। কিন্তু রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ই কোভিড সংক্রান্ত তথ্য গোপন করছে এবং এই ত্রুটি ঢাকতে বার বার মিথ্যা বলছে।