E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪০ সংখ্যা / ২১ মে, ২০২১ / ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

নারদ ঘুষ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত চার নেতা-মন্ত্রীকে গৃহবন্দি থাকার নির্দেশ হাইকোর্টের


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ নারদ কাণ্ডে ধৃত তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের গৃহবন্দি থাকার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ। ২১ মে এই রায়দানের পাশাপাশি চার নেতা-মন্ত্রীর অন্তর্বর্তী জামিন নিয়ে দুই বিচারপতির মতভেদ হওয়ায় এই মামলা পাঠানো হয় বৃহত্তর বেঞ্চে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, যতদিন না বৃহত্তর বেঞ্চের রায় হয় ততদিন এই চার নেতা-মন্ত্রীকে গৃহবন্দি থাকতে হবে বলে জানিয়েছে হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ। এই রায়ে আরও বলা হয়েছে, যাঁরা কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রশাসনিক কাজে যুক্ত,তাঁরা ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারবেন।তবে তাঁরা সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে পারবেন না।

১৭ মে সকালে নারদ ঘুষকাণ্ডে সিবিআই রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি এবং ফিরহাদ হাকিম সহ তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র ও প্রাক্তন তৃণমূল নেতা শোভন চ্যাটার্জিকে গ্রেপ্তার করে।তাঁদের সবাইকে আনা হয়েছিল সিবিআই দপ্তর নিজাম প্যালেসে। তারপরই সেখানে দফায় দফায় শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষোভ, ভাঙচুর, বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এসব ঠেকাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী লাঠিচার্জও করে। অবস্থা আরো জটিল হয় যখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ১০:৪০ মিনিট নাগাদ নিজাম প্যালেসে চলে আসেন।তারপর থেকেই কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাইক, গাড়ি, ম্যাটাডোর করে রীতিমতো পতাকা ও ব্যানার লাগিয়ে তৃণমূলীরা জড়ো হতে থাকে নিজাম প্যালেসের সামনে। লকডাউনে জনমানবহীন রাস্তায় নিমেষে বিশাল ভিড় জমে যায়। তখন সেখানে দূরত্ববিধি মানাতো দূরের কথা, ধাক্কাধাক্কি হুড়োহুড়ি চলতে থাকে।নিজাম প্যালেস ঘিরে শুরু হয় তৃণমূলীদের তাণ্ডব। ওরা যথেচ্ছভাবে ইট, পাথর, জলের বোতল ছুঁড়তে থাকে গেট আগলে দাঁড়িয়ে থাকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দিকে। নিজাম প্যালেসের সামনে রাখা লোহার ব্যারিকেডগুলোকে সরিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ চালাতে থাকে শাসক দলের বাহিনী। এরফলে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে।তৃণমূলীরা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে দলীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এই সমস্ত বিশৃঙ্খল কার্যকলাপ,তাণ্ডবের ছবি তুলতে গিয়ে আক্রান্ত হন চিত্র সাংবাদিকরা। লকডাউনে সাধারণ মানুষকে বাড়ির বাইরে বেরুনোর ক্ষেত্রে পুলিশ কঠোর বিধিনিষেধ জারি করলেও,শাসক দলের সদস্যরা এসব কিছুকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে কলকাতায় নিজাম প্যালেসের সামনে, রাজভবনের বাইরে, পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায়। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বারে বারে প্রচারিত হতে থাকে দলীয় মন্ত্রী-নেতাদের মুক্ত নাকরে মুখ্যমন্ত্রী নিজাম প্যালেস ছাড়বেন না। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী এবং শাসকদলের অন্যান্য মন্ত্রী,সাংসদ, নেতাদের নিজাম প্যালেসে উপস্থিত হওয়া দলীয় কর্মীদের অবরোধ বিক্ষোভে বাড়তি উৎসাহ জোগায়। মুখ্যমন্ত্রী সকাল থেকে প্রায় ছ’ঘণ্টা নিজাম প্যালেসে বসে দলের ধৃত নেতা-মন্ত্রীদের ছাড়াতে সিবিআই অফিসারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।

নিজাম প্যালেসের সামনে তৃণমূলের তাণ্ডব -বিশৃঙ্খলা চলার সময়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি গেটের সামনে রাজ্য পুলিশ বাহিনী থাকলেও তারা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থেকে শাসক দলের এই সমস্ত অরাজকতা প্রত্যক্ষ করেছে। করোনার মারণ সংক্রমণের মোকাবিলায় একদিকে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে,অন্যদিকে সরকার ও শাসক দল নিজেরাই সেই আইন ও বিধিনিষেধ ভেঙে কদর্য নজির তৈরি করেছে।

এদিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে ধৃতদের নামে চার্জশিট পেশ করা হয়।সেখানে তাঁরা জামিন পেলেও রাতেই এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সিবিআই কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন জানায়।সেখানে প্রধান বিচারপতির এজলাসে ভার্চুয়াল শুনানির পর নিম্ন আদালতের অন্তবর্তীকালীন জামিনের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় হাইকোর্ট। এরপর ধৃত চারজনকেই নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। সেখানে কিছুক্ষণ রাখার পর মদন মিত্র, শোভন চ্যাটার্জি এবং সুব্রত মুখার্জিকে শারীরিক অসুস্থতার জন্য এস এস কে এম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯ মে হাইকোর্টে শুনানি চলে। কিন্তু কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।এদিন শুনানির সওয়াল-জবাবে মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘ সময় ধরে নিজাম প্যালেসে ধরনা, নিম্ন আদালতে শুনানির সময় আইন মন্ত্রী মলয় ঘটকের উপস্থিতি এবং সিবিআই দপ্তরের বাইরে তৃণমূলীদের বিক্ষোভ ও হিংসার ঘটনা উঠে আসে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে যে নারদ অভিযুক্তদের জামিন খারিজ করে জেল হেপাজতের পথ প্রশস্ত করেছে তা স্পষ্ট হয়।পরদিন ফের শুনানির দিন ঠিক থাকলেও অনিবার্য কারণে তা হয়নি।২১ মে হাইকোর্ট তার রায়ে ধৃতদের গৃহবন্দি অবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়ে মামলা বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠায়।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময়ে ম্যাথু স্যামুয়েলের তত্ত্বাবধানে নারদ নিউজের স্টিং অপারেশন হয়। ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ সেই ভিডিয়ো ফুটেজ সামনে আসে এবং তাতে তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন মোট ১২ জন সাংসদ, মন্ত্রী,বিধায়ক সহ তৃণমূল ঘনিষ্ট এক আইপিএস অফিসারকে হাত পেতে কয়েক লক্ষ টাকা ঘুষ নিতে দেখা যায়।২০১৭ সালে নারদ কাণ্ডে সিবিআই রায় দেয়। সিবিআই এবং ইডি বিভিন্ন ধারায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এই মামলায় ম্যাথু স্যামুয়েলকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। মামলা চলাকালীন মৃত্যু হয় অন্যতম অভিযুক্ত সুলতান আহমেদের।গ্রেপ্তার করা হয় পুলিশ আধিকারিক এস এম এইচ মির্জাকে। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে শ্লথ গতিতে চলতে থাকে এই মামালা। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, দীর্ঘদিন লালকৃষ্ণ আদবানির নেতৃত্বাধীন সংসদের এথিকস কমিটির কোনো বৈঠক বসেনি। তৎকালীন অভিযুক্ত সাংসদদের গ্রেপ্তারের সম্মতিও মেলেনি। এছাড়াও আশ্চর্যের বিষয় হলো,ঘটনাসূত্রে জানা যায়,নারদ নিউজ ডটকমের প্রতিনিধি হিসেবে ম্যাথু স্যামুয়েলকে এই স্টিং অপারেশনের ৮০ লক্ষ টাকা তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ কে ডি সিং জুগিয়েছিল।একাধিকবার এই দাবি জানান সে সময় তহেলকার সঙ্গে যুক্ত ম্যাথু স্যামুয়েল।

সুব্রত মুখার্জি, ফিরাদ হাকিম, মদন মিত্র এবং শোভন চ্যাটার্জিদের কোভিড পরিস্থিতিতে এভাবে আচমকা গ্রেপ্তারের ঘটনায় কেন্দ্রের সরকার ও শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ আনে তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের পক্ষ থেকে এই প্রশ্নও তোলা হয় যে, একই ঘটনায় তৃণমূলের দুই প্রাক্তন সাংসদ ও বর্তমানে বিজেপি’র নেতা ও বিধায়ক মুকুল রায় ও শুভেন্দু অধিকারীকে কেন গ্রেপ্তার করা হল না? এছাড়া সিবিআইয়ের এই পদক্ষেপে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় অনুমতি দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধেও চক্রান্তের অভিযাগ আনে তৃণমূল।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ মে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, পাঁচ বছর ধরে নারদ ঘুষকাণ্ডে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে এখন মহামারীতে সীমাহীন অপদার্থতা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেইসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, দুর্নীতির সঙ্গে আপস করে, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে নিয়ে বিজেপি’র মতো ভয়ঙ্কর শক্তিকে যে মোকাবিলা করা যায়না এই শিক্ষা তৃণমূল কংগ্রেসেরও গ্রহণ করা উচিত। সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি’র ফ্যাসিবাদী কায়দায় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হলে নিজেদের দলের অভ্যন্তরে দুর্নীতি ও বিরোধীশূন্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে।

বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এদিন একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, বামফ্রন্ট মনে করে, দেশে বিজেপির মতো ভয়ঙ্কর শক্তিকে মোকাবিলা করতে হলে, এমনকি রাজ্যের মানুষজনকে বিজেপি সম্পর্কে মোহমুক্ত করতে হলে তৃণমূল কংগ্রেসকেও দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপস করার মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। করোনা মহামারীকে জরুরি ভিত্তিতে মোকাবিলা না করে বিজেপি’র তৈরি করা চক্রান্তকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানায় বামফ্রন্ট।